1 Answer

0 like 0 dislike
by
edited by anonymous

বিবেকানন্দ, স্বামী (১৮৬৩-১৯০২)  দার্শনিক, ধর্মিয়-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর পারিবারিক নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। স্বামী বিবেকানন্দ এক অনন্য সাধারণ প্রতিভা—যিনি আধুনিক কালের ধর্ম-সংস্কৃতি এবং পরোক্ষভাবে ভারতীয়দের জাতীয় আত্মচেতনার রূপ দিতে সাহায্য করেছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হিন্দুধর্মীয় জীবনব্যবস্থা, আচরণ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও  তিনি হিন্দুধর্মের বহু আদর্শিক বিচ্যুতির কড়া সমালোচক ছিলেন। তিনি একটি ভাবাদর্শ প্রচার এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন কর্মসূচি প্রদান করেছিলেন। তাঁর সময়ের তুলনায় বহু দিক থেকে প্রাগ্রসর চিন্তার অধিকারী  বিবেকানন্দের জাতীয় পুনর্জীবনের পথ ও পন্থা নিয়ে বহু ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে।

স্বামী বিবেকানন্দ
উত্তর কলকাতার শিমলা বা শিমুলিয়া গ্রামের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে নরেন্দ্রনাথ দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত একজন ধনবান এবং সফল সরকারি উকিল ছিলেন। এ পরিবার উত্তরাধিকারসূত্রে ইন্দো-মুগল যুগের সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লাভ করেছিল। জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের উদার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে তার আংশিক প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। দত্ত পরিবারে শুভ বা উত্তম জীবনধারণ, বিশেষ করে খাদ্যে একটা পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত রুচির পরিবেশ রক্ষা করা হতো। ফলে সন্ন্যাস জীবনেও বিবেকানন্দ তাঁর উত্তম বা শুভ জীবনধারণের প্রতি ভালোবাসা পরিত্যাগ করেননি। ‘দুঃখ চাতামি’ বা নিম্ন জীবনধারণে আনন্দলাভ করা তাঁর নিকট সবসময় ঘৃণার বিষয় ছিল। তিনি নিজে মুগল ঐতিহ্যের একজন বিখ্যাত পাচক ছিলেন।
বিবেকানন্দের পরিবারে এমন একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে, দেবতা শিবের আশীর্বাদ নিয়ে বিবেকানন্দের জন্ম, কারণ তাঁর মা শিবের নিকট একটি পুত্র সন্তান কামনা করেছিলেন। শৈশবকাল থেকেই তাঁর মধ্যে অপার্থিব ধ্যান-ধারণার লক্ষণ দেখা দিলে তাঁর মা বিশ্বাস করেন যে, তাঁর পুত্র স্বয়ং শিব অবতাররূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি মাটির তৈরি প্রিয় দেবদেবীর মূর্তির সামনে বসে প্রার্থনা করতেন এবং কখনো কখনো সমাধিতে চলে যেতেন। প্রথমে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল বীরেশ্বর ওরফে বিলে, কিন্তু পরবর্তীকালে এ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নরেন্দ্র।
প্রথমে নিজ গৃহে মায়ের নিকট এবং পরে একজন গৃহশিক্ষকের নিকট নরেন্দ্রর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। কলকাতার মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে তাঁর স্কুল জীবন, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও পরে জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে (পরবর্তীকালে স্কটিশ চার্চ কলেজ) তাঁর কলেজ জীবন শুরু, এবং ১৮৮৩ সালে এখান থেকেই তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কলেজ জীবন থেকেই তিনি এক তৃপ্তিহীন পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান অন্বেষণে ব্রতী হন। তিনি ব্যাপক ও গভীরভাবে পড়াশুনা শুরু করেন। তাঁর বৌদ্ধিক বা একাডেমিক আগ্রহের মধ্যে ছিল দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি। একজন যুব-সত্যানুসন্ধানকারী হিসেবে ঈশ্বর জ্ঞানলাভের প্রতিও তাঁর গভীর আগ্রহ জন্মলাভ করে। তিনি রাজা রামমোহন  রায়ের বেদান্তবিষয়ক গ্রন্থাদি পাঠ করে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হন।কেশবচন্দ্র সেন এ আন্দোলনের একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলে নরেন্দ্র তাঁর বক্তৃতা শুনতেন এবং তাঁর সংগঠিত সভাসমিতিতে ভক্তিমূলক সংগীত পরিবেশন করতেন।

বাঙালি সমাজে খ্যাতনামা আধ্যাত্মিক পুরুষদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের জিজ্ঞাসা করতেন তাঁরা ‘ঈশ্বরকে দেখেছেন কিনা’। বলা হয়ে থাকে এরকম প্রশ্নের উত্তরে বিখ্যাত মরমি সাধক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর  বলেছিলেন তিনি অবশ্য ঈশ্বরকে দেখেননি, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস নরেন্দ্র অবশ্যই ঈশ্বরকে দেখার সাধনায় সার্থক হবেন। জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশনের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড হেস্টি নরেন্দ্রকে রামকৃষ্ণ-এর কথা বলেন
এবং তাঁকে আধ্যাত্মিক সাধনায় আবিষ্ট পুরুষ হিসেবে বর্ণনা করেন। নরেন্দ্র যথারীতি তাঁকে এ প্রশ্ন  জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেন,     ‘হ্যাঁ, আমি তাঁকে দেখেছি এবং তোমাকেও দেখাতে পারি।’ নানা প্রকার বাস্তবধর্মী প্রশ্ন ও তর্ক-বিতর্কের পর অল্প সময়ের মধ্যে নরেন্দ্র প্রথমে রামকৃষ্ণের ভক্ত এবং অচিরেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
নরেনের জীবনে এমন একটি সময় আসে যখন তিনি পার্থিব জীবন এবং সন্ন্যাস জীবনের যে কোনো একটি গ্রহণ করার বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। এ সময় তিনি আইন বিষয়ে পড়াশুনা করছিলেন, কিন্তু পিতার মৃত্যুর কারণে তিনি পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তাঁকে তাঁর পরিবারের ভরণপোষণের দায়ভার গ্রহণ করতে হয় এবং তিনি মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
নরেনের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে তাঁর পিতার একটি পরিকল্পনা ছিল। তিনি ইংল্যান্ডে যাবেন এবং ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে এসে আইন ব্যবসা শুরু করবেন। কিন্তু অধ্যাত্ম-জীবনের প্রতি আকর্ষণই তাঁর নিকট বড় হয়ে দেখা দেয় এবং তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণের আশায় বাড়ি ত্যাগ করেন। শিষ্য কর্তৃক রচিত বিবেকানন্দের বহু জীবনী এবং স্মৃতিকথা রয়েছে। কিন্তু গুরুর নিকট থেকে তারা কী শিক্ষালাভ করেছেন—এ প্রশ্নের উত্তরে সকলেই নীরব থাকেন। মানবসেবা এবং বিশেষ করে পাশ্চাত্যে বেদান্ত ও যোগদর্শন প্রচারের জন্য যখন বিবেকানন্দ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন, তখন তিনি বলেন তিনি যা কিছু করছেন তা গুরুর নির্দেশেই করছেন। কিন্তু তাঁর কর্মসূচি ও গুরুর শিক্ষার মধ্যে সুনির্দিষ্ট সম্পর্কের বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। তাঁর গুরু অধিকাংশ সময় দেবীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন এবং তাঁকে দেবী মা-কালি হিসেবে ‘দেখেছিলেন’। তিনি আরও দাবি করেছিলেন যে, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মসহ সব প্রধান ধর্মের মরমি ভাবধারার মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরকে উপলদ্ধি করেছিলেন। বিবেকানন্দ তাঁর জীবন ও শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন, কিন্তু তাঁর ধ্যান ধারণাগুলি  কখনো প্রচার করার চেষ্টা করেননি, বা রামকৃষ্ণের অনুলিখিত কোনো গ্রন্থে আমরা মানব সেবার বিশেষ করে অনগ্রসর শ্রেণির জনগণের  সেবার উল্লেখ পাই না। অথচ এ মানবসেবাই ছিল বিবেকানন্দের জীবনসাধনার মূলকথা।
রামকৃষ্ণের মৃত্যুর (১৬. ৮. ১৮৮৬) পর নরেন্দ্র ও তাঁর বারজন শিষ্য কলকাতার উপকণ্ঠ বরাহনগরে একটি ‘মঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তাঁরা গুরুর নিকট থেকে শিক্ষালদ্ধ আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন। এশিয়াটিক সোসাইটি গ্রন্থাগার থেকে বই এনে তাঁরা সেখানে গভীরভাবে বৌদ্ধিকচর্চাও শুরু করেন। তাঁদের স্তবসংগীতের মধ্যে একটি কৌতুহলোদ্দীপক মন্ত্র হচ্ছে ‘প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হউক’ (Vive la republique) যা তাঁদের এ পার্থিব জগতের রাজনৈতিক আদর্শের ইঙ্গিত প্রদান করে। বিবেকানন্দের নেতৃত্বে পরিচালিত আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে বেশ কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। বরাহনগর মঠে থাকাকালীন বিবেকানন্দ তাঁর সন্ন্যাসী নাম বিবেকানন্দ গ্রহণ করেন। পরে কোনো একসময়ে ববিশানন্দনামে আরেকটি নাম গ্রহণ করেন।
বরাহনগর মঠে কিছুকাল ‘সাধনার’ অর্থাৎ আধ্যাত্মিক অনুশীলনের পর শিষ্যগণ সন্ন্যাসীদের নিয়ে আরেকটি কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আধ্যাত্মিক জ্ঞানে আলোকিত হওয়ার জন্য তাঁরা সকলে পরিব্রাজক অর্থাৎ কপর্দকহীন পর্যটক হিসেবে বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ শুরু করেন। এ নতুন কর্মসূচিতে বিবেকানন্দ কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। এ সময় তিনি জয়পুরের রাজপন্ডিতদের নিকট পাণিণির ব্যাকরণ, ক্ষেত্রবীর মহারাজার রাজপন্ডিত নারায়ণ দাসের নিকট পতঞ্জলির মহাভাষ্য এবং পোরবন্দের পান্ডুরাঙ্গের নিকট বেদান্ত পাঠ করেন। এ ভ্রমণ শেষে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ শিষ্য তুরীয়ানন্দ তাঁকে ঈশ্বর উপলদ্ধি করেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করেন। তিনি এর নেতিবাচক উত্তর দিয়ে বলেন তিনি একটি মাত্র জিনিস শিখেছেনলল— মানুষকে ভালোবাসা। তিনি আরও একটি বিষয় শিক্ষালাভ করেছেনল-ক্ষুধা। বিবেকানন্দ তাঁর অনুপমেয় ভঙ্গিতে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে, মাঠ ও কলকারখানার শ্রমিকগণ ন্যায়সঙ্গতভাবেই এ পৃথিবীর মালিক। অধিকতর সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষিত শ্রেণির কর্তব্য হচ্ছে শিক্ষার মাধ্যমে অনগ্রসর শ্রেণিকে তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করা এবং প্রয়োজনীয় সেবার মাধ্যমে তাদের পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করা। বাকি বিষয়গুলি তারা নিজেরাই দেখাশুনা করবে এবং যথাসময়ে তাদের প্রাপ্য বিষয় দাবি করবে। এ উক্তির মধ্যে তাঁর ধর্ম প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য সারাংশ আকারে বিদ্যমান রয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সব সম্ভাবনার দেশ মনে করেন। উপরিউক্ত উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য একটি সংস্থা বা মিশন প্রতিষ্ঠার সকল প্রয়োজনীয় সম্পদ এখান থেকে লাভ করা সম্ভব। এছাড়া ভারতবর্ষকে শিল্পায়িত করার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞানলাভ এখান থেকে সম্ভব।

2,114 questions

2,171 answers

14 comments

41 users

Ask BCS Question এ আপনাকে সুস্বাগতম, এখানে আপনি প্রশ্ন করতে পারবেন এবং অন্যান্য সদস্যদের নিকট থেকে উত্তর পেতে পারবেন।

বিগত 30 দিনের জনপ্রিয় প্রশ্ন

Categories

...