রীমদ্ভগবদ্গীতা বা গীতা ৭০০-শ্লোকের সনাতন ধর্মাবলম্বীর একটি ধর্মগ্রন্থ। এটি প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারএর একটি অংশ।
যদিও গীতাএকটি স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থ তথা একটি পৃথক উপনিষদের মর্যাদা পেয়ে থাকে। হিন্দুরা গীতাকে ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণীই মনে করেন। হিন্দুধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের ইতিহাসে গীতা এক বিশেষ স্থানের অধিকারী। গীতা-র কথক কৃষ্ণ হিন্দুদের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের অবতার পরমাত্মা স্বয়ং। তাই গীতা-য় তাঁকে বলা হয়েছে “শ্রীভগবান”।
গীতা-র বিষয়বস্তু কৃষ্ণ ও পাণ্ডব রাজকুমার অর্জুনের কথোপকথন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু ঠিক আগে শত্রুপক্ষে আত্মীয়, বন্ধু ও গুরুকে দেখে অর্জুন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন।এই সময় কৃষ্ণ তাঁকে ক্ষত্রিয় যোদ্ধার ধর্ম স্মরণ করিয়ে দিয়ে এবং বিভিন্ন প্রকার যোগশাস্ত্র ও বৈদান্তিক দর্শন ব্যাখ্যা করে তাঁকে যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেন। তাই গীতা-কে বলা হয় হিন্দু ধর্মতত্ত্বের একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ এবং হিন্দুদের জীবনচর্যার একটি ব্যবহারিক পথনির্দেশিকা।
যোগশাস্ত্র ব্যাখ্যার সময় কৃষ্ণ নিজের “স্বয়ং ভগবান” রূপটি উন্মোচিত করেন এবং বিশ্বরূপে অর্জুনকে দর্শন দিয়ে আশীর্বাদ করেন। অর্জুন ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণের মুখ থেকে গীতা শুনেছিলেন সঞ্জয় (তিনি যুদ্ধের ঘটনা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করার জন্য বেদব্যাসের কাছ থেকে দিব্য দৃষ্টি লাভ করেছিলেন), হনুমান (তিনি অর্জুনের রথের চূড়ায় বসে ছিলেন) ও ঘটোৎকচের পুত্র বর্বরিক যিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সব ঘটনা দেখেছিলেন)।
গীতা-কে গীতোপনিষদ বলা হয়। অর্থাৎ, গীতা উপনিষদ্ বা বৈদান্তিক সাহিত্যের অন্তর্গত। “উপনিষদ্” নামধারী ধর্মগ্রন্থগুলি শ্রুতিশাস্ত্রের অন্তর্গত হলেও, মহাভারত-এর অংশ বলে গীতা স্মৃতিশাস্ত্রের অন্তর্গত। আবার উপনিষদের শিক্ষার সারবস্তু গীতা-য় সংকলিত হয়েছে বলে একে বলা হয় “উপনিষদ্সমূহের উপনিষদ্”। গীতা-কে মোক্ষশাস্ত্র নামেও অভিহিত করা হয়।ভারতীয় মণীষীদের পাশাপাশি অ্যালডাস হাক্সলি, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, জে. রবার্ট ওপেনহাইমার, রালফ ওয়াল্ডো এমারসন, কার্ল জাং, হেনরিক হিমার ও হারমান হেস প্রমুখ পাশ্চাত্য মণীষীরাও গীতা-র উচ্চ প্রশংসা করেছেন।
যেহেতু বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়, সেহেতু মহাভারতের অংশ রূপে গীতাও তাঁর দ্বারাই রচিত বলে মনে করা হয়। ভগবদ্গীতার রচনাকাল সম্বন্ধে অনেক রকম মতামত রয়েছে। ঐতিহাসিকেরা এই গ্রন্থের রচনাকাল হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত যে কোন সময়ের মধ্যে হতে পারে বলে অনুমান করেছেন। অধ্যাপক জীনীন ফাউলারের মতে এই গ্রন্থের রচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী বলে মনে করলেও, গীতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কাশীনাথ উপাধ্যায় মহাভারত, ব্রহ্ম সূত্র ও অন্যান্য গ্রন্থ পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে, গীতা খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীতের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য গবেষকদের মধ্যে ভগবদ্গীতা-র অনুবাদ ও চর্চা শুরু হয়। এই সময় থেকেই ভগবদ্গীতা-র জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক খুশবন্ত সিংয়ের মতে, রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের বিখ্যাত কবিতা “ইফ—” হল ইংরেজিতে ভগবদ্গীতা-র বাণীর সারমর্ম।
ভগবদ্গীতা শুধুমাত্র মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের মতো বিশিষ্ট ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা ও দার্শনিকদের দ্বারাই প্রশংসিত হয়নি, বরং অ্যালডাস হাক্সলে, হেনরি ডেভিড থরি, জে. রবার্ট ওপেনহিমার রালফ ওয়াল্ডো এমারসন, কার্ল জাং, হারমান হেস ও অন্যান্যদের দ্বারাও প্রশংসিত হয়েছে। ভগবদ্গীতা-য় উল্লিখিত নিষ্কাম সেবা ছিল গান্ধীর অনুপ্রেরণা। তিনি লিখেছেন:
যখন সংশয় আমাকে তাড়া করে ফেরে, যখন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে হতাশা, আমি দিগন্তে আশার কোনো আলো দেখতে পাই না, তখন আমি ভগবদ্গীতার দিকে মুখ ফেরাই। এমন একটি শ্লোক পেয়ে যাই, যা আমাকে শান্তি দেয়। তখন ঘনায়মান দুঃখের মধ্যেও আমার মুখে হাসি ফোটে। আমার জীবন বাহ্যিক ব্যর্থতায় পরিপূর্ণ। আমার জীবনে যদি তাদের কোনো দৃশ্য বা অদৃশ্য প্রভাব না থাকে, তার জন্য আমি ভগবদ্গীতার শিক্ষার প্রতি কৃতজ্ঞ।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ভগবদ্গীতা প্রসঙ্গে বলেছেন: ভগবদগীতা মানব অস্তিত্বের আধ্যাত্মিক ভিত্তিটির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। জীবনের দায়দায়িত্ব ও কর্তব্যকর্মের জন্য কর্মের ডাক দেওয়া হয়েছে গীতায়। সেই সঙ্গেই আধ্যাত্মিক প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের বৃহত্তর উদ্দেশ্যটির দিকেও দৃষ্টি রাখা হয়েছে।
আমেরিকান পদার্থবিদ ও ম্যানহ্যাটন প্রজেক্টের পরিচালক জে. রবার্ট ওপেনহিমার ১৯৩৩ সালে সংস্কৃত শিখে ভগবদ্গীতা মূল সংস্কৃতে পাঠ করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই বইটিকে জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলির একটি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেছিলেন যে ১৯৪৫ সালে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষাটি দেখার পর ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়ের ৩২ সংখ্যক শ্লোকটি থেকে “এখন আমি বিশ্ববিধ্বংসী মৃত্যু হয়েছি” কথাটি তাঁর মনে পড়েছিলো।
ফিলিপ গ্লাস তাঁর সত্যাগ্রহ (১৯৭৯) অপেরায় দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর আন্দোলনের প্রথম পর্যায়টি তিনি ভগবদ্গীতার মাধ্যমে দেখান। অপেরার মূল লিবারেটো অংশটি মূল সংস্কৃতে ভগবদ্গীতা গানের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। ডগলাস জে. কোমোর অর্জুন’স ডায়ালেমা অপেরায় ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সাংগীতিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে অর্জুনের দ্বিধার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়। ১৯৯৩ সালে জি. ভি. আয়ার পরিচালিত সংস্কৃত চলচ্চিত্র ভগবদ্গীতা ১৯৯৩ সালে শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
দ্য লেজেন্ড অফ ব্যাগার ভেন্স উপন্যাস (১৯৯৫) ও গলফ চলচ্চিত্রটি (২০০০) ভগবদ্গীতা অবলম্বনে নির্মিত। গীতায় মোট ৭০০ টি শ্লোক নিয়ে ১৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত আছে।