বাঙালি নারীকে তিনি শিখিয়েছিলেন নারীরাও দেশের জন্য লড়াই করতে পারে, শিখিয়েছেন বিপ্লবের জন্য স্বাধীনতার জন্য কী করে হার না মেনে চালিয়ে যেতে হয় এক জীবন। এক জন্মের কর্মে কেমন করে থেকে যেতে হয় মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। বাঙালি নারী চিরকাল কেবল অবলা নয়। যে বাঙালি নারী আজীবন গৃহের কোণে থাকে কেবলই সাংসারিক কাজকর্মে। সেই নারীকে তিনি চিনিয়েছেন দেশের জন্য, বিপ্লবের জন্য একটি জীবনকে কতোখানি মহিমান্বিত করা যায়। কী করে গর্জে ওঠা যায় শোষকের বিরুদ্ধে। তাই তো তিনি অগ্নিকন্যা।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে। তার বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানী আর মা প্রতিভাদেবী ছিলেন গৃহিণী। পরিবারে ছয় ভাই বোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। প্রথমে তার বড় মধুসূদন, তারপর প্রীতিলতা, এরপর কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ। বহু পূর্বে নামের শেষে তাদের পদবী ছিল দাশগুপ্ত। পরিবারের কোনো এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে “ওয়াহেদেদার” উপাধি পেয়েছিলেন বলে নামের শেষে যুক্ত হয়েছিল এই ওয়াহেদেদার থেকে ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার। শৈশবে প্রীতিলতার বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার তার বাবার মৃত্যুর পর নিজের পৈতৃক বাড়ি ডেঙ্গাপাড়া সপরিবারে ত্যাগ করেন পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে মামার বাড়িতে বড় হয়েছিলেন। এই বাড়িতেই প্রীতিলতার জন্ম হয়েছিল। মা প্রতিভাদেবী প্রীতিলতাকে আদর করে ডাকতেন “রাণী”। এক সময় ধলঘাট ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে আসে প্রীতিলতার পরিবার। চট্টগ্রাম শহরের আসকার দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে টিনের ছাউনি দেয়া মাটির একটা দোতলা বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করে ওয়াদ্দেদার পরিবার। এখানেই বেড়ে ওঠা প্রীতিলতার।
প্রীতিলতাদের ধলঘাটের বাড়ি ছিল এখানে। এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ছবি: সংগৃহীত
ছোটবেলা থেকেই কিছুটা অন্তর্মুখী, অনেকটা মুখচোরা ও লাজুক প্রীতিলতা। মায়ের সঙ্গে গৃহস্থলীর কাজে দারুণ পটু ছিল। ঘরের নানা কাজে মাকে সাহায্য করতো ছোট্ট রাণী।
প্রীতিলতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় সাত বছর বয়সে ১৯১৮ সালে ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে। প্রতি ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রীতিলতার ফলাফল ছিল দারুণ। ভালো ফলাফলের জন্য সব শিক্ষকই ভীষণ স্নেহ করত প্রীতিলতাকে। সেই শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষা দি। তিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাই এর ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন। স্কুলে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন কল্পনা দত্ত। এক বছরের বড় প্রীতিলতা কল্পনার সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতো। তাদের স্বপ্নের কথা পরবর্তী কালে লিখেছিলেন কল্পনা দত্ত। লিখেছিলেন “কোন কোন সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসীর রানী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম।”
প্রীতিলতা তখন সবে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রেখেছেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা তখন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন শেষে সক্রিয় হচ্ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২৩-এর ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস এর মোড়ে সূর্য সেনের বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭ হাজার টাকা ছিনতাই করে। এ ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন অবস্থায় বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সাথে যুদ্ধের পর গ্রেপ্তার হন সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। তাদের বিরুদ্ধে করা হয় রেলওয়ে ডাকাতি মামলা। এই ঘটনা কিশোরী প্রীতিলতার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
স্কুলের প্রিয় শিক্ষক ঊষা দির সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই মামলার ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে অনেক কিছুই জানতে পারেন তিনি। ঊষা দির দেওয়া “ঝাঁসীর রাণী” বইটি পড়ার সময় ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাইয়ের জীবনী তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল।
১৯২৪ সালে বেঙ্গল অর্ডিনান্স নামে এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনা বিচারে আটক করা শুরু হয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলের অনেক নেতা ও সদস্য এই আইনে আটক হয়েছিল। তখন বিপ্লবী সংগঠনের ছাত্র আর যুবকদের অস্ত্রশস্ত্র, সাইকেল ও বইপত্র গোপনে রাখার ব্যবস্থা করতে হতো। সরকার বিপ্লবীদের প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। প্রীতিলতার নিকট-আত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন বিপ্লবী দলের কর্মী। তিনি বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। তখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্রী। লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি পড়েন “দেশের কথা”, “বাঘা যতীন”, “ক্ষুদিরাম” আর “কানাইলাল”। এই সব বই প্রীতিলতাকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে।
প্রীতিলতা দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে বিপ্লবী সংগঠনে যোগ দেওয়ার গভীর ইচ্ছার কথা বলেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত বিপ্লবী দলে নারী সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কোনো মেয়েদের সাথে মেলামেশা করাও বিপ্লবীদের জন্য নিষেধ ছিল।
স্কুলে আর্টস এবং সাহিত্য প্রীতিলতার প্রিয় বিষয় ছিল। ১৯২৬ সালে সংস্কৃত পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন প্রীতিলতা। ১৯২৮ সালে তিনি কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। শুধু গণিতের নাম্বার খারাপ ছিল বলে তিনি বৃত্তি পেলেন না।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ছুটির সময় নাটক লেখেন প্রীতিলতা এবং মেয়েরা সবাই মিলে সে নাটক চৌকি দিয়ে তৈরি এক মঞ্চে পরিবেশন করেছিলেন। পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ার সময়টাতে তার বাড়িতে এক বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু প্রীতিলতার প্রবল আপত্তির কারণে বিয়ের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছিলেন তার মা।